রম্য কাহিনী – পর্ব ২ লেখক: গিয়াস উদ্দিন আহাম্মাদ




রম্য কাহিনী – পর্ব ২

লেখক: গিয়াস উদ্দিন আহাম্মাদ

আমার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে ছেলেটি দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। বাকিরা তখনো দাঁড়িয়ে, যেনো আদেশের অপেক্ষায়। আমি জানি কিছু একটা ভয়ঙ্কর হতে যাচ্ছে। গলার স্বর শুকিয়ে এসেছে, চোখে পানি জমে উঠেছে কিন্তু আমি আর কাঁদতে পারছি না। এখন আমার মধ্যে শুধুই একটাই অনুভূতি—বাঁচতে হবে। আর যেভাবেই হোক আমাকে এই দুনিয়ার সামনে দাঁড়াতে হবে।

রাতটা নরক হয়ে এলো। আমি সেসব বর্ণনা করতে পারবো না। পারি না, তবুও বলতে হয়—একজন, দু’জন, তিনজন... সাতজন। যেন আমি কোনো মানুষ নই, একটা বস্তু, একটা খেলনা মাত্র। কেউ থামাতে আসেনি, কেউ বাঁচাতে আসেনি।
একা আমি, সাতজন জানোয়ারের মাঝে।

পরদিন ভোরে আমার চোখ খুলতে পারিনি ঠিকমত। শরীরের প্রতিটি কোষ ব্যথায় কাঁপছিল। একটা কম্বলের মতো কিছু গায়ে জড়ানো ছিলো। রক্তের গন্ধ, ঘামের গন্ধ, কাঁটার মতো বিঁধছিল নাকে। ঘরটা তখন ফাঁকা, দরজাও খোলা।
হাঁটতে হাঁটতে বের হয়ে এলাম। মনে হচ্ছিল কোথাও একবার দম নিতে পারলে বাঁচি।

গেটের দিকে যেতে না যেতেই তাকে আবার দেখলাম—ওই ঝাকড়া চুলের ছেলে। হাতে এক কাপ কফি, মুখে সেই অদ্ভুত ঠান্ডা হাসি।
— এত তাড়াহুড়া কেনো প্রিন্সেস? এখনও তো খেলা বাকি!
আমি দৌড়াতে চাইলাম, কিন্তু সে এগিয়ে এসে আমার পথ আটকালো।
— একবার চিন্তা করে দেখো... জীবনটাকে নতুনভাবে শুরু করতে পারো। আমি চাইলে তোমাকে আমার করে নিতে পারি। সবাই যা করেছে, ওটা একটা খেলা ছিলো। কিন্তু আমি তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছি।

আমি স্তব্ধ। মাথায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এই লোকটা কী বলছে? যাকে একদিন আগেও হায়েনার মতো মনে হচ্ছিল, আজ সে আমাকে ‘তার করে নেওয়ার’ কথা বলছে?

আমি কিছু বলিনি। শুধু তাকিয়ে ছিলাম তার চোখে। একটা কথা মাথায় ঘুরছিলো—এই লোকটার ভেতরে একটা ছায়া আছে... আর আমি যদি এটাকে ভাঙতে পারি, তবে কি প্রতিশোধ নেয়া সম্ভব?

**

তিনদিন পর, কে যেন আমাকে একটা নির্জন রাস্তার পাশে ফেলে গেছে। অচেতন অবস্থায় একটা বয়স্ক মহিলা আমাকে পেয়েছিলো। ওনার সহায়তায় আমি বাড়ি ফিরি।

কিন্তু ফিরে এসেই যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছি, সেটা পুরো পরিবারকে কাঁপিয়ে দিলো।
— আমি ওদের একজনকে বিয়ে করতে চাই।

এটা শুনে আমার বাবা প্রথমে কিছুই বলতে পারেননি। মা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। ভাইয়েরা চুপচাপ, রাগে ফুঁসছিলো।
তারা জানে না, আমি কাকে বিয়ে করতে চাই।
তারা জানে না, আমার এই সিদ্ধান্তের পেছনে কী ভয়ানক প্ল্যান লুকিয়ে আছে।

হ্যাঁ, আমি প্রতিশোধ নিতে চাই। কিন্তু কোর্ট-কাছারি, পুলিশ এসব আমার চাই না।
আমি ওর ভেতরে ঢুকতে চাই। আমি ওর বিশ্বাস অর্জন করতে চাই। আমি চাই সে ভালোবাসার মোহে আমার সামনে সব সত্য খুলে বলুক—ওর নাম, ঠিকানা, তার অপরাধের ইতিহাস... আর বাকি ছয় জনের পরিচয়।

এই যুদ্ধ আমি একা লড়বো।

রাত গভীর হয়, আমি জানালার পাশে বসে থাকি। আকাশে তারা জ্বলে, আবার নিভে যায়। আমার হৃদয়ে ক্ষত, কিন্তু মস্তিষ্কে এক অদ্ভুত স্থিরতা।
এই যুদ্ধ যদি হেরে যাই, তবে সম্মান শুধু রক্তাক্ত হবে না, মরে যাবে চিরতরে।

আমার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত একটা অধ্যায় এখন শুরু হতে যাচ্ছে। যে ছেলেটি এক রাতে আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছিল, আজ আমি তাকেই বিয়ে করতে চাই—এটা ভাবলেই নিজেকে পাষাণ মনে হয়। কিন্তু এই নাটকের নেপথ্যে রয়েছে এমন এক সত্য, যার মাধ্যমে আমি ওদের সবার মুখোশ খুলে দিতে চাই।

তিন দিন কেটে গেছে আমার সেই ঘোষণার পর। পুরো বাড়িতে একধরনের থমথমে পরিবেশ। মা চোখে-মুখে অভিমান, ভাইয়েরা রাগে ফুসছে, বাবা যেন নিশ্চুপ এক প্রস্তর মূর্তি। আমি কল্পনাও করিনি আমার এ সিদ্ধান্ত এতটা ঝড় তুলবে পরিবারে।

তবু আমি নীরব। এই নীরবতা আমার যুদ্ধের প্রথম অস্ত্র।

**

সেদিন সন্ধ্যায় বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন।
আমি নিঃশব্দে গিয়ে বসলাম তার সামনে। বাবা চুপ করে বসে ছিলেন কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন—

— কে সে?

আমি থমকে গেলাম।
— তুমি ওদের একজনকে বিয়ে করতে চাও বলেছো। আমি জানতে চাই, সে কে?

আমি ধীরে বললাম,
— আমি এখনও নিশ্চিত না বাবা। আমি শুধু চেহারা মনে রেখেছি, নাম বা পরিচয় না। তবে আমি খুঁজে বের করবো। তুমি শুধু আমাকে সময় দাও।

বাবা ভ্রু কুঁচকে বললেন,
— সময় চাইছো? তুমি কি জানো তুমি কী চাইছো?

আমি চোখ তুলে বাবার চোখে তাকালাম।
— জানি। ভালো করেই জানি।

তারপর উঠে চলে এলাম ঘর থেকে।

**

এখন আমার হাতে আছে কেবলমাত্র সেই ঝাকড়া চুলওয়ালা ছেলেটির মুখ, তার আচরণ, তার অদ্ভুত ঠান্ডা চোখের চাহনি আর একটা নাম—যেটা সেদিন কেউ তাকে ডেকেছিলো: “রাফি ভাই”।

এই নামটুকুই এখন আমার একমাত্র সূত্র।

সোশ্যাল মিডিয়াতে সার্চ দিয়ে যাচ্ছি একটার পর একটা “রাফি” নামের প্রোফাইল।
প্রতিটা ছবির চুল খেয়াল করি—ঝাকড়া কি না। কারো ছবি ভালো করে জুম করে দেখি চোখের দৃষ্টি মিলে কিনা।
হঠাৎ একটা প্রোফাইলে গিয়ে থমকে গেলাম।

ছেলেটার ছবিতে সেই একই ঠান্ডা, অদ্ভুত হাসি। নাম: Rafi Al Noman
বেশ কয়েকটা ছবিতে দামি গাড়ি, দামি জামা, গলাতে সোনার চেইন, ডান পাশে সব সময় কয়েকজন যুবক—চেহারা গডফাদার টাইপের।

আমি নিশ্চিত এই লোকটিই সেই রাতের লিডার। আমার মনে পড়ছে, তার চোখ, তার চুল, এমনকি সেই ভয়ংকর গলা।

প্রোফাইল ঘেটে একটা তথ্য পেলাম—সে নিয়মিত একটি ক্যাফেতে যায় বন্ধুদের সঙ্গে।
“Bliss Café”। ঠিকানাও দেওয়া আছে।

**

পরদিন আমি নিজেই সেই Bliss Café-তে গেলাম।
একটা সাধারণ পোশাক পরে, মুখে হালকা মেকআপ দিয়ে এমনভাবে সাজলাম যেন কেউ সন্দেহ না করে।
ক্যাফেতে ঢুকে এক কোণে বসে পড়লাম। এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে চারপাশে নজর রাখছি।

প্রায় আধঘণ্টা পর, তাকে আসতে দেখলাম।

রাফি।
ঠিক সেই চেহারা। গলায় সোনার চেইন, চোখে সানগ্লাস, পাশে দুই বন্ধু। হেসে হেসে কথা বলছে।

আমি হৃদপিণ্ডের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি নিজের কানে। হাত কাঁপছে। কিন্তু মুখে কঠিন এক অভিব্যক্তি রাখলাম।
আজ এই রাফির সামনে দাঁড়াতে হবে আমাকে।

সে ক্যাফের একদম সামনের টেবিলে বসল। কিছুক্ষণ পরে ওয়েটারকে ডেকে কফির অর্ডার দিলো।

আমি ধীরে হাঁটলাম ওদের টেবিলের দিকে।
তারা আমাকে দেখে একটু তাকালো। আমি খুব সাহস করে বললাম—

— এক্সকিউজ মি, আমি কি এখানে বসতে পারি? অন্য টেবিলগুলো তো সব ফিল আপড।

রাফি আমাকে এক ঝলক দেখে ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি টেনে বললো,
— অবশ্যই বসুন। আপনার মতো সুন্দরী মেয়ে চাইলে আমার পাশে সারাদিন বসতে পারেন।

আমি ভিতরে ভিতরে গলে যাচ্ছি, কিন্তু মুখে মুচকি হেসে বসে পড়লাম।
এটাই আমার প্রথম চাল। এই খেলাটা আমিই শুরু করলাম।

**

সেদিন আমি এক ঘন্টা কাটালাম ওদের সঙ্গে। আমার পরিচয় দিলাম “মুন” নামে। বললাম, মিডিয়াতে কাজ করি। কথা বললাম, মজা করলাম—সবই অভিনয়।
রাফি আমার নম্বর চাইল। আমি হেসে বললাম,
— ফেসবুকে আমাকে খুঁজে নিও। আমার ইউজারনেম: @moon.me.

রাফি বললো,
— সুন্দর নাম... ঠিক তোমার মতোই রহস্যময়।

হ্যাঁ, আমি এখন রহস্যই হতে চাই।
রাফি জানে না, তার খেলায় আমি এখন নিজেই খেলোয়াড়।
আমি এখন আগুনে ঝাঁপ দিয়েছি, পুড়তে পুড়তেই ওদের ছাই করে দিতে চাই।

চলবে...


৩য় পর্ব লিংক 

https//wwwrohosmotkhahini.com

0 Post a Comment:

Post a Comment