রম্য কাহিনী
পর্ব: ৫
লেখক: গিয়াস উদ্দিন আহাম্মাদ
এক বৃষ্টিভেজা সকাল।
চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে ছিলাম।
হঠাৎ বাড়ির দারোয়ান এসে বলল—
— “ম্যাডাম, আপনার নামে একটা চিঠি এসেছে। জেল থেকে পাঠানো।”
আমার বুক ধক করে উঠলো।
চিঠি? জেল থেকে? কে পাঠাবে?
খামের উপর স্পষ্ট লেখা—
**প্রাপক: রম্য রহমান**
**প্রেরক: রাফি খান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার।**
তাড়াতাড়ি ঘরে এসে দরজা বন্ধ করলাম।
চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলাম।
---
**"রম্য,**
আমি জানি, তোমার কাছে আমি পশুর চেয়েও নিচু।
তোমার চোখে আমি একজন ধর্ষক।
তুমি ঘৃণা করো আমাকে— এটা জানি।
কিন্তু আমি শুধু একটা কথা বলতে চাই—
আমি তোমাকে কখনও ছুঁইনি।
তুমি যেদিন আমাদের চোখে পড়েছিলে, আমি রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম।
আমার বন্ধুদের নিষেধ করেছিলাম।
কিন্তু ওরা শোনেনি।
আমি ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিলাম।
তবে ভয় পেয়েছিলাম, ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে।
আমার দুর্বলতা…
আমার চুপ করে থাকা…
আমার না বলার সাহস না থাকা— সেটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ।
তোমার সাথে যা হয়েছিল, তার পরে আমি নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারিনি।
তাই আমি স্বেচ্ছায় আদালতে সব বলেছি।
নিজের দোষ মেনেও নিয়েছি, কারণ আমার নীরবতা তো আরেকটা অপরাধ।
তোমার সাহস দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম রম্য।
তুমি তো আমাদের চেয়ে অনেক বড়।
তুমি সাহস দেখালে।
আমি দেখাতে পারিনি।
আমি জানি, এই চিঠি পড়ে তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না।
তবে আমার অন্তরের যন্ত্রণা যদি এক ফোঁটাও তোমার ভার হালকা করে— তাহলেই আমার শান্তি।
রাফি"\*\*
---
চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো।
চিঠিটা বুকের কাছে চেপে ধরলাম।
এখনও বুঝতে পারছি না—
আমি ওকে ঘৃণা করবো, না করুণা?
সে কি সত্যিই অপরাধী?
নাকি সময়ের চাপে নীরব থেকে আরেক অপরাধী হয়ে উঠেছিল?
**সন্ধ্যা নামতেই বাবার কাছে চিঠিটা দেখালাম।**
তিনি চুপ করে অনেকক্ষণ পড়ে রইলেন।
তারপর ধীরে বললেন—
— “এই চিঠি প্রমাণ করে, দোষী শুধু যে হাতে আঘাত করে, সে নয়… যে চোখ ফিরিয়ে নেয়, সে-ও সমান অপরাধী। কিন্তু হয়তো redemption এখনও সম্ভব…”
আমি কিছু বললাম না।
কিন্তু সেই রাতে…
চোখ বন্ধ করতেই বারবার একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো—
**রাফির চোখ…**
সেদিনের সেই তীব্র দৃষ্টির বদলে আজ শুধু অনুশোচনা আর গ্লানি।
রাফির চিঠির পর সেই রাতে এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারিনি।
মনের ভেতর একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে—
আমি কী বিশ্বাস করবো ওর বলা কথা?
নাকি এটাও একটা সাজানো নাটক?
সকালে বাবা চুপচাপ আমার ঘরে এলেন।
একটা কাগজ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন—
“এইটা রাফির প্রোফাইল… আমি নিজে খোঁজ নিয়ে এনেছি।”
##
**রাফি খান**
জন্ম : পুরান ঢাকা
বাবা ছিলেন একসময় নামকরা সাংবাদিক।
মা কলেজের অধ্যাপিকা।
কিন্তু রাফি যখন ক্লাস টেন, তখন বাবা মারা যান এক সড়ক দুর্ঘটনায়।
মা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।
রাফির পড়াশোনা থেমে যায়, আর সেই সময় থেকেই সে মিশতে শুরু করে “ভাইয়ের গ্রুপে”।
প্রথমে টাকার লোভে, পরে নিজের অবস্থান রক্ষায়।
ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে এক ‘ফ্রন্ট লাইন প্লেয়ার’।
চোখে-মুখে চিন্তা কম, কিন্তু ভেতরে লুকানো বুদ্ধিমত্তা ছিল প্রচুর।
সেই গ্রুপের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটাই ঘটলো আমার সাথে।
আর সেই ঘটনায় রাফির ভূমিকা ছিল— **“নীরব দর্শক”**।
আমি ভেবেছিলাম, ওদের একজনেরও মন গলে না…
কিন্তু রাফির এই চিঠি, তার অতীত আর পুলিশের দেওয়া তথ্যে দেখলাম—
সে ঘটনার পর থেকে সে অনেক কেঁদেছে।
অনেকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছে।
এমনকি পুলিশ কাস্টডিতে থাকা অবস্থায় একবার গলায় ব্লেড চালাতে গিয়েছিল।
তবে ও কি সত্যিই **ততটাই ভালো**?
না কি নিজেকে বাঁচানোর জন্য এসব অভিনয়?
সন্ধ্যাবেলা মা এসে বললেন—
“তুমি যদি চাও, আমরা রাফিকে জেলেই রাখবো। চিরদিন। চাইলে বিদেশে পাঠিয়ে দেই তোমাকে।”
আমি শুধু একটাই কথা বললাম—
**“আমি ওকে একবার দেখতে চাই…”**
সবাই থমকে গেলো।
মা চুপ।
বাবার চোখে শঙ্কা।
ভাইয়া কাঁপা গলায় বলল—
“তুই ঠিক করিস? যে তোকে…!”
আমি ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিলাম—
“যে আমাকে ছুঁয়েও দেখেনি, কিন্তু চুপ থেকেছে… আমি শুধু জানতে চাই কেনো। একবার… একবার মুখোমুখি হলে বুঝতে পারবো।”
**শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, আমি রাফিকে দেখতে যাবো।**
**ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার।**
জেল গেটের সামনেই বুক ধড়ফড় করছিল।
নাম রেজিস্টারে সই করে, স্ক্যানিং পেরিয়ে একটা ছোট রুমে বসিয়ে দেওয়া হলো আমাকে।
পাঁচ মিনিট পর, পুলিশি পাহারায় ঢুকলো রাফি।
চোখে ক্লান্তি, মুখে দাড়ি-গোঁফ।
আমার দিকে তাকিয়েই মাথা নিচু করে ফেললো।
আমি ধীরে বললাম—
**“তুমি কি সত্যিই কিছু করোনি?…”**
সে চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে।
তার চোখে এখন ভয় নেই, লোভ নেই, শুধু—
**আত্মগ্লানি।**
সে কাঁপা গলায় বললো—
“আমি তোদের থামাতে পারিনি।
তাই তো নিজেকে মানুষ মনে হয় না।
তুই যদি বলিস, আমি এখানেই মরে যাবো।”
আমার বুকটা ধক করে উঠলো।
আর কিছু বললাম না।
চোখ দুটো শুধু টলমল করে উঠলো…
এই প্রথম, আমি ধর্ষকের চোখে দেখলাম **পশুত্ব নয়, পাষাণ বেদনা।**
**চলবে…**
৬ষ্ঠ পর্ব লিংক
0 Post a Comment:
Post a Comment