রম্য কাহিনী – পর্ব ৩
লেখক: গিয়াস উদ্দিন আহাম্মাদ
রাফি এখন আমাকে "মুন" নামে চেনে। তার ধারণা, আমি এক আধুনিক, স্বাধীনচেতা মিডিয়া গার্ল। এবং সে আমার প্রতি আগ্রহী—খুব দ্রুতই।
এই সুযোগটাই আমি চেয়েছিলাম। আগুনে পুড়িয়ে ছাই করার জন্য প্রথমে আগুনটাকে কাছে আনতেই হবে।
**
আজকে আমার ফেসবুক ইনবক্সে রাফির মেসেজ—
"Hi Moon, কাল Bliss ক্যাফেতে আসবা? তোমার সঙ্গে একটু দেখা করতে ইচ্ছা করছে…"
আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রিপ্লাই দিলাম—
"Maybe… যদি তুমি আমাকে চা খাওয়াও, তাহলে ভাবা যায়।"
রাফি রিপ্লাই করলো এক চিলতে ইমোজি আর একটা ভয়েস—
"তোমার জন্য শুধু চা না, পুরো Bliss বুক করতেও রাজি আছি মুন…"
আমি ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।
এই লোকটাই সেই রাতের রাক্ষস।
তবুও আমি নিজেকে শান্ত করলাম—এখনো অনেক পথ বাকি।
**
পরদিন বিকেলে আবার সেই Bliss Café।
এইবার আমি হালকা নীল শাড়ি পরে এসেছি। নিজের মধ্যে একদম ভিন্ন একটা “মুন” গড়ে তুলেছি।
রাফি আমাকে দেখে চমকে উঠলো।
— ওয়াও! আজ তো পুরোপুরি সিনেমার হিরোইন লাগছে তোমায়।
আমি হেসে বললাম,
— ধন্যবাদ। তুমি আজও সেই গডফাদার মোডে আছো মনে হচ্ছে।
রাফি হাসলো,
— আমি এমনই... পাওয়ার দেখাতে ভালো লাগে।
সেদিন আমাদের মধ্যে অনেক কথা হলো। ওর বন্ধুরা দুজন এসে কিছুক্ষণ পর চলে গেলো। রাফি এবার একটু কাছাকাছি হয়ে আমার দিকে ঝুঁকে বললো—
— তুমি জানো মুন, তোমার চোখে কেমন একটা গভীর রহস্য আছে… অনেকটা কষ্ট লুকানো থাকে যেমন।
আমি এক মুহূর্ত থেমে বললাম—
— হয়তো। কিছু কষ্ট বলার নয়। ঠিক যেমন কিছু অপরাধও... ধরা পড়ে না সহজে।
রাফি মুহূর্তের জন্য চুপ করে গেলো। তার চোখে এক মুহূর্তের সন্দেহ।
কিন্তু আমি আবার হেসে বললাম—
— চিন্তা করো না, আমি গল্প করতে ভালোবাসি। সত্য-মিথ্যার মাঝে হারিয়ে যাই মাঝে মাঝে।
সে আবার হাসলো। আর আমি বুঝলাম, সন্দেহ কেটে গেছে।
**
রাত ৮টার দিকে রাফি আমাকে ক্যাফের বাইরে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলো।
— আজকে চমৎকার একটা সন্ধ্যা কাটলো, বললো সে।
আমি উত্তর দিলাম—
— ধীরে ধীরে আমাকে বুঝবে, তখন আরও চমৎকার মনে হবে।
গাড়ির দরজা বন্ধ করার সময় আমি তাকিয়ে বললাম—
— তুমি কি কখনো এমন কিছু করেছো, যা বললে তোমার পরিচিত জগৎ তোমাকে চেনে না?
রাফি এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো আমার চোখে, তারপর হেসে ফেললো—
— আমার সবকিছুই রহস্যে মোড়া। আমি যা করি, তার সিক্স পারসেন্টও কেউ জানে না।
আমি মাথা নেড়ে হালকা বললাম—
— আমি একদিন সেই শতভাগ জানবো রাফি…
গাড়ি ছাড়তেই আমার মনে হচ্ছিল আমি একটা দুঃস্বপ্নের পেছনে ছুটছি, যার শেষে হয়তো আমি নিজেও আর থাকবো না।
**
ঘরে ফিরে দেখি বাবা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন।
— কোথায় ছিলে তুমি?
— একটা প্রজেক্টের কাজে।
— মিথ্যে বলো না।
বাবার কণ্ঠে রাগ নয়, বরং হতাশা।
— আমি ঠিক পথে আছি বাবা। শুধু একটু বিশ্বাস করো।
বাবা চলে গেলেন চুপচাপ। মা কেঁদে ফেললেন। আমি ওদের সামলাতে পারি না।
কারণ আমি জানি, এই যুদ্ধের মূল্য আমার পরিবারকেও দিতে হবে।
**
পরদিন সকাল।
আমার মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ—
"Moon, I like you… Let's go for a long drive today. Just you and me." – Rafi
আমি হেসে ফেললাম। ঠিক এই সুযোগটাই চাই।
এখন আমি চাই রাফি নিজেই তার মুখোশ খুলে ফেলুক।
আর তার আগে, আমি সব রেকর্ডিং চালু রাখবো।
আমার মোবাইলে গোপনে রেকর্ডিং অ্যাপ সেট করেছি।
আজকের ডেটই হবে সেই ভয়াবহ রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার স্বীকারোক্তির সূত্র।
আমি জবাব দিলাম—
"Deal. But I have a condition… I’ll tell you during the drive."
**
সন্ধ্যায় আমরা শহরের বাইরের দিকে যাচ্ছি। গাড়ির মধ্যে হালকা মিউজিক।
রাফি গাড়ি চালাচ্ছে, আমি চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে আছি।
মোবাইল পাসেঞ্জার সিটের নিচে চালু রেকর্ডিং মোডে।
হঠাৎ রাফি বললো—
— জানো মুন, আমি জীবনটাকে গেমের মতো দেখি। আমরা যা চাই, তা নিয়ে নিই। ভয় পেলে মানুষ কিছুই পায় না।
আমি হালকা স্বরে বললাম—
— এমন কী নিয়েছো তুমি রাফি, যা ভয় না পেলে পেতে না?
রাফি হাসলো।
— আমি আর আমার বন্ধুরা এক রাতে একটা “রাজকন্যাকে” ধরে এনেছিলাম। একদম হট ছিলো। কিন্তু ওই রাতে বুঝেছি, ভয়, কান্না, আর লজ্জা—এই তিন জিনিস মেয়েদের কন্ট্রোলে রাখতে সবচেয়ে কার্যকর।
আমি চুপ করে আছি। রাফির মুখে উন্মাদ এক আত্মবিশ্বাস।
সে আরো বললো—
— মেয়েটার চেহারা এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। ওর চোখে তখন আগুন ছিলো, কিন্তু আমরা ওটাকেই ভাঙলাম।
আমার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এলো। চোখ বেয়ে নেমে এলো জল।
রাফি এখনো জানে না—
এই "রাজকন্যা"ই আজ তার পাশে বসে আছে,
আর তার স্বীকারোক্তি, এখন আমার মোবাইলে রেকর্ড হচ্ছে।
রাফি কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল। চোখে জল, কণ্ঠ ভারী। তারপর বলল,
— “আমি জানি, আমি দানব ছিলাম… এখনও মনে হলে নিজেকে ঘৃণা হয়। কিন্তু… তোমার জন্য নয়, নিজের জন্য। কারণ আমি জানি, আমি তোমার মতো একটি মেয়েকে… চিরজীবনের মতো ভেঙে দিয়েছি।”
আমি চুপ। কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না মুখ থেকে। শুধু তাকিয়ে আছি তার দিকে।
রাফি বলতে লাগল,
— “আমি অন্যদের মতো ছিলাম না। আমি ওদের থামাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শেষমেশ… আমিও নিজেকে থামাতে পারিনি। ভীড়ের উন্মাদনায় আমি হেরে গিয়েছিলাম… আমার বিবেককে চাপা দিয়েছিলাম… আমি দানবে পরিণত হয়েছিলাম।”
আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। শিউরে উঠছে শরীর। কিন্তু আশ্চর্য, আজ আমি আর কাঁদি না। আমার চোখে এখন শুধুই শীতল রাগ, প্রতিশোধের আগুন।
রাফি আবার বলল,
— “তুমি জানো? ওরা তো তোমাকে মেরে ফেলতেই চেয়েছিল। আমি বাধা দিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, ওকে জীবিত ফিরিয়ে দাও, নয়তো যা করেছি সব ফাঁস করে দেব। তখন ওরা আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিল। কিন্তু ওদের মুখ বন্ধ রেখেছিল আমার পুরনো শক্তি আর ভয়।”
আমি রেকর্ডারটা চালু করে রেখেছি গোপনে। তার স্বীকারোক্তি, তার মুখেই— এখন আমার কাছে অস্ত্র।
সে বলল,
— “তুমি যখন বিয়ের প্রস্তাব দিলে, আমি ভেবেছিলাম এটা কোনো ফাঁদ। আবার ভেবেছিলাম, যদি সত্যিই এটা একটা সুযোগ হয়… তাহলে হয়তো একবার নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি।”
আমি এবার ঠান্ডা গলায় বললাম,
— “তুমি কি চাও আমি তোমায় ক্ষমা করি?”
সে এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল,
— “না। আমি চাই না তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি শুধু চাই তুমি আমাকে ব্যবহার করো… তোমার পথের পাথরগুলো সরাতে। আমার শাস্তি তুমি নিজেই দাও… আমি তাতেই রাজি।”
আমি এবার উঠে দাঁড়ালাম।
— “তাহলে প্রস্তুত হও, রাফি। তুমি বলেছো তুমি শক্তিশালী? এবার আমি চাই তুমি নিজেই তোমার বন্ধুদের নাম বলো। এবং এটা রেকর্ড হবে। সব মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়বে।”
রাফি চমকে উঠল।
— “তুমি… রেকর্ড করছো?”
আমি ঠাণ্ডা হাসলাম,
— “হ্যাঁ। শুরু থেকেই। এবার যদি তুমি সত্যিই অনুতপ্ত হও, তবে ওদের নাম বলো। কে কে ছিলো? কার কী ভূমিকা ছিলো? কোথায় ওরা এখন?”
রাফি কিছুক্ষণ চুপ থেকে চোখ বন্ধ করল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
— “ওরা সাতজন ছিলো। আর আমি… সেই সাতজনের একজন।
১. রাশেদ – পরিকল্পনাকারী।
২. সোহেল – গাড়ির চালক, আমাকে সন্দেহ করে আজকাল।
৩. জুবায়ের – ভিডিও করেছিল।
৪. রাফিদ – মদ এনে দিয়েছিল।
৫. কামরুল – ভিকটিমকে ধরেছিল প্রথমে।
৬. আসিফ – ঘর পাহারা দিচ্ছিল।
৭. আমি… রাফি – যাকে তুমি বিয়ে করতে চাও।
এরা সবাই এখন ছড়িয়ে আছে শহরের নানা প্রান্তে। রাশেদ দেশের বাইরে পালাতে চাচ্ছে।”
আমি রেকর্ড বন্ধ করলাম। এবার আমার হাতে অস্ত্র। আমি জানি, আগামীকাল মিডিয়া, পুলিশ, আদালত— সবকিছু তোলপাড় হবে এই স্বীকারোক্তিতে।
আমি ধীরে ধীরে বললাম,
— “তুমি আমার শত্রু, আবার আজকের অস্ত্রও তুমি। এই দ্বৈত অবস্থানেই তোমার জায়গা থাকবে আমার জীবনে।”
রাফি কিছু বলল না। শুধু মাথা নিচু করে বসে রইল।
---
চলবে...
৪থ পর্ব লিংক
https//www.rohosmoypartfour.com
0 Post a Comment:
Post a Comment