রম্য কাহিনী পর্ব: ৪ লেখক: গিয়াস উদ্দিন আহাম্মাদ

 




রম্য কাহিনী

পর্ব: ৪

লেখক: গিয়াস উদ্দিন আহাম্মাদ


আমি ঠিক করেছিলাম— এবার আর চুপ থাকবো না। সমাজের ভয়ে নয়, পরিবারের ‘সম্মান’ রক্ষার ভয়ে নয়, নিজের ভিতরের ভয়কেই আজকে আমি চিরতরে গলা টিপে মারব।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি বাবা চুপচাপ বসে আছেন। চোখের কোণে অঘোষিত উদ্বেগের ছাপ।

আমি নিচে নেমে এলাম। হাতে একটা পেনড্রাইভ।


— "বাবা, আজকে একটা জিনিস তোমাকে দেখাতে চাই।"


তিনি চমকে তাকালেন আমার দিকে।

আমি কোনো কথা না বলে ল্যাপটপ খুলে পেনড্রাইভ ঢুকালাম।

ওপরে ভেসে উঠল একটি ভিডিওর নাম:

**"স্বীকারোক্তি – রাফি"**


চলতে শুরু করল ভিডিও। রাফির স্বর, চেহারা, ভঙ্গি— সব কিছুই ধরা পড়েছে ক্যামেরায়।

এক এক করে সে বলছে সাত ধর্ষকের নাম, প্রতিটির ভূমিকা, পরিকল্পনার বিবরণ।

ভিডিও শেষ হতেই ঘরে নেমে এলো নিস্তব্ধতা।


বাবার মুখে গভীর ঘৃণা, কিন্তু সঙ্গে এক অপার বিস্ময়।

— "এই ভিডিওটা তুমি করেছো?"

আমি মাথা নেড়ে বললাম,

— "হ্যাঁ, বাবা। এবং আমি এটা আজ দুপুরেই সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করবো।"


বাবা কিছু বললেন না। শুধু ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন—

— "আজ বুঝলাম, তুই শুধু আমার মেয়ে না… তুই একজন যোদ্ধা।"



দুপুর ১২টা।

ঢাকার একটি নামি হোটেলে সাংবাদিক সম্মেলন।

প্রায় সব নামী টিভি চ্যানেল, অনলাইন পোর্টাল উপস্থিত।

আমি সাদা সালোয়ার কামিজ পরে স্টেজে উঠলাম।

পেছনে আমার বাবা।

মাইক্রোফোনে মুখ আনতেই পুরো হল নিঃশব্দ।


আমি বললাম:

— "আমি এক ধর্ষণকাণ্ডের ভিকটিম। আমাকে সাতজন মিলে ধর্ষণ করেছিলো। আজ তাদের একজন— রাফি— তার অপরাধ স্বীকার করেছে। আমি তা রেকর্ড করেছি। আমি এই ভিডিও আজ আপনাদের সামনে প্রকাশ করছি যাতে আর কোনো মেয়ে ন্যায়ের জন্য ভীত না থাকে।"


তারপর ভিডিও চলতে শুরু করল।

সবার চোখ ফাঁক হয়ে গেল।

রাফির মুখ, তার স্বীকারোক্তি, পরিকল্পনার বিবরণ— সবকিছু ধরা পড়ল।



বাংলাদেশের প্রতিটি সংবাদপত্রের হেডলাইন:

**"ধর্ষকের স্বীকারোক্তি: এক সাহসী মেয়ের লড়াই"**

**"রম্য কাহিনী নয়, এ এক রক্তাক্ত বাস্তবতা"**

**"রাফি ও তার ছয় সহযোগী গ্রেপ্তার চেষ্টায় পুলিশ"**


ওই দিন রাতেই রাশেদ পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে বিমানবন্দরে।

জুবায়ের গা ঢাকা দেয়, বাকিদের বিরুদ্ধে রেড জারি হয়।

রাফি নিজেই থানায় আত্মসমর্পণ করে।



তবে এই কাহিনী এখানেই শেষ নয়।

রাফি যখন কোর্টে তোলে, বিচারক তাকে প্রশ্ন করেন—

— "তুমি কি বিয়েতে সম্মত হয়েছিলে নিজের ইচ্ছায়?"

সে মাথা নিচু করে বলে—

— "না। আমি জানতাম, সে আমাকে ব্যবহার করবে। এবং আমি সেটাই চেয়েছিলাম। কারণ আমি চাই তার হাতে আমার শাস্তি শুরু হোক।"


পুরো আদালত স্তব্ধ।

বিচারক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন,

— "এই কোর্ট মনে করে, এই ধর্ষণকাণ্ড শুধু একজন মেয়ের বিরুদ্ধে অপরাধ নয়, বরং গোটা সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক চরম আঘাত।"


আদালতের নির্দেশে রাফিসহ বাকিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন শুরু হয়।

আর আমি?

আমি নতুনভাবে জীবন শুরু করি।

সবার সামনে, নিজের পরিচয় লুকোই না আর।

আমি গর্ব করে বলি—

**"হ্যাঁ, আমি ভিকটিম। কিন্তু এখন আমি বিজয়িনী।"


ঢাকার আদালত চত্বরে আজ জনস্রোত।
আমার মামলার শুনানি আজ।
রাফি এবং তার ছয় সহযোগী হাজির আছে আদালতের কাঠগড়ায়।
আদালত চুপ। বিচারকের কণ্ঠ স্থির, গম্ভীর—
কিন্তু তাঁর কথায় যেন বজ্রপাতের মতো কম্পন জাগে চারদিকে।

— “এই আদালত মনে করে, এই ঘটনা শুধুমাত্র একজন নারীর ওপর পাশবিকতা নয়, বরং রাষ্ট্র এবং ন্যায়বিচারের চেতনাকেই অপমান করার প্রচেষ্টা। সাতজন মিলে এক তরুণীকে অপহরণ করে ধর্ষণ করেছে— প্রমাণসহ তা প্রমাণিত। তাই…”

তিনি একটুখানি থেমে বললেন—
— “সাতজনকেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো। রাফির ক্ষেত্রে… তার স্বীকারোক্তি ও সহায়তার কারণে দণ্ড কিছুটা কমানো হলো— তবে তাকে দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হচ্ছে।”

ঘরের এক পাশে বসে থাকা আমি চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস ফেললাম।
না, আমি খুশি না।
আমি শান্ত।

কারণ আমি জানি, ওরা শাস্তি পেয়েছে।
এবং সবচেয়ে বড় শাস্তি হলো—
সারা দেশ আজ ওদের নাম জানে।
কেউ মুখ লুকিয়ে বাঁচতে পারবে না।

এক মাস পর…

আজ আমি আবার ভার্সিটির ক্যাম্পাসে ফিরলাম।
অনেকেই ঘুরে তাকালো, কেউ চোখ নামিয়ে নিলো, কেউবা এগিয়ে এসে বললো,
— "তুমি আমাদের অনুপ্রেরণা।"

আমার একসময়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ফারহানাও এগিয়ে এসে বললো,
— "তুই পারলি রে রম্য… এত সাহসীভাবে দাঁড়াতে? আমি তো কল্পনাও করতে পারি না…"

আমি শুধু হাসলাম। বললাম না কিছু।

বাড়ি ফিরতেই বাবা বসে ছিলেন বারান্দায়।
হাত বাড়িয়ে ডেকে বললেন,
— “তোর জন্য একটা চমক আছে।”

আমি অবাক হয়ে এগিয়ে গেলাম।
বাবা একটা খাম এগিয়ে দিলেন।
ভেতরে একটা চিঠি।

খুলে দেখি—

"আপনার সাহসিকতা ও অবস্থান নারীর ক্ষমতায়নে অনন্য উদাহরণ। আমরা আপনাকে আমাদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।"

আমার চোখ ছলছল করে উঠলো।
একটা অন্ধকারের গল্প শেষ করে আজ আমি আলোয় দাঁড়িয়ে আছি।
আমি জোরে বলে উঠলাম—
— “বাবা, আমি যাচ্ছি। আমি এখন শুধু তোমার মেয়ে না— আমি এখন হাজার মেয়ের আশা।”

তবে...

এই গল্প এখানেই শেষ নয়।
কারণ কিছু প্রশ্ন এখনও রয়ে গেছে—
রাফি কেন একা স্বীকার করলো?
সে কি শুধুই অনুতপ্ত ছিল?
না কি আরও কিছু আছে তার ভিতরে লুকোনো?

[চলবে…]

0 Post a Comment:

Post a Comment