রম্য কাহিনী পর্ব: ৬ লেখক: গিয়াস উদ্দিন আহাম্মাদ

  

রম্য কাহিনী

পর্ব: ৬

লেখক: গিয়াস উদ্দিন আহাম্মাদ





জেলের সেই ছোট্ট রুমে রাফির চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ।

সে কিছু বলেনি, আমিও না।

শুধু নিঃশব্দে আমাদের দু’জনার চোখে যেন ঝড় বয়ে চলেছে—

সে ঝড়ের নাম **অপরাধবোধ** আর **অবিচারের অভিমান**।


সে বললো না— “ক্ষমা করো।”

আমি বললাম না— “তুমি দোষী।”

তবুও অনুভব করলাম, **সেই নীরবতা অনেক কিছু বলে দিলো**।



বাড়ি ফিরে বাবা কিছু বলেননি।

মা চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়ে শুধু বললেন—

“তুমি কি সত্যি… ওকে বিয়ে করতে চাও?”

আমি মাথা নিচু করে বললাম—

“জানি মা, কথাটা পাপের মতো শোনায়।

কিন্তু… আমি তো অন্য কাউকে কল্পনাও করতে পারি না এখন।”


মা চোখ মুছলেন।


"সে তোমার সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে রম্য…!"


আমি বললাম—

"আর সেই ক্ষতির ভার নিয়েই সে পুড়ছে এখন।

আমার মনে হয়, জীবনের সবচেয়ে কঠিন শাস্তি সে পেয়েছে—

**নিজেকে ক্ষমা করতে না পারা।**

আর আমি যদি ওকে ঘৃণা করেই যাই, তাহলে তো ওর মধ্যে ভালো কিছুর জন্মই হবে না, মা।

তাহলে কি লাভ?"



পরদিন সকালেই বিষয়টা জানাজানি হয়ে যায়।

মিডিয়া, প্রতিবেশী, আত্মীয়—

সবাই আমাদের বাড়ির সামনে ভিড় করতে লাগলো।


বাবার মুখে একটাও কথা নেই।

একটা মুহূর্তে মনে হলো, বাবা আমাকে ত্যাগ করে দেবেন।

কিন্তু হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে বাবা ডেকে বললেন—


"আমার মেয়ে যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা তার ব্যক্তিগত।

আমরা বিচারক না।

আর আমি যদি আজ তাকে ত্যাগ করি, তাহলে আমি তার সেই শক্তির উৎসটাই ভেঙে ফেলবো যেটা ওকে আবার বাঁচতে শিখিয়েছে।"




সেদিন বাবা আমার জন্য প্রথমবারের মতো দাঁড়ালেন সমাজের বিরুদ্ধে।


সবার মুখ থ মেরে গেলো।




কিন্তু… সমস্যা তো এত সহজে শেষ হয় না!


রাফি এখনও জেলে।

তাকে আইনি প্রক্রিয়ায় জামিন পেতে হবে।

আমার পরিবার থেকে একটা আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হলো।

বেশ কয়েকটা শুনানি চললো।

জজ সাহেব কিছুটা অবাক, কিছুটা সংশয়ে বললেন—


“এই দেশে এমন উদাহরণ নেই।

একজন ধর্ষিতা তার ধর্ষকের জন্য জামিন আবেদন করছে! এটা তো সমাজের চোখে অন্যরকম বার্তা।”


আমি বললাম—

**“সমাজ যদি ভালো দিকটা দেখতে না পারে, তাহলে আমার কিছু করার নেই।

আমি শুধু একটা মানবিকতার গল্প লিখতে চাই, যার শেষটা হোক আলোর দিকে।”**



**আদালত রায় দিলো:**


**রাফি জামিন পাবে— তবে কয়েকটি কঠোর শর্তে:**


১. সে সামাজিক পুনর্বাসন কার্যক্রমে অংশ নেবে।

২. সরকার অনুমোদিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে থাকবে ছয় মাস।

৩. আদালতের নির্দেশ ছাড়া দেশ ত্যাগ করতে পারবে না।


আমি এই রায় শুনে চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললাম।

এ যেন বিজয়ের না হলেও, **বাঁচার অধিকার ফিরে পাওয়ার এক ঘোষণা**।



শেষ রাতে মা এসে বললেন—

“তুই কি সত্যি বিশ্বাস করিস, রাফি তোকে ভালোবাসে?”


আমি বললাম—

“মা, ভালোবাসা সব সময় ফুল, ক্যান্ডি, প্রেমপত্র না…

কখনো কখনো তা **পশ্চাৎপটে দাঁড়িয়ে, নিজের শাস্তি নিজে ভোগ করার নামও।**”


মা আর কিছু বলেননি।

শুধু কপালে একটা চুমু এঁকে দিয়ে চলে গেলেন।



রাফি জামিনে মুক্তি পেলো।


ঘরভর্তি মানুষ। মিডিয়ার ক্যামেরা।

আমি চুপচাপ সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

রাফির চোখে পানি… আর ঠোঁটে একটাই কথা—


**“তুমি নিশ্চিত? আমি তো এখনো নিজের চোখে তাকাতে পারি না…”**


আমি শুধু হাতটা বাড়িয়ে দিলাম…


আর বললাম—

**“তুমিও বাঁচো। আমিও বাঁচি।

মিলেমিশে নয়… নিজেদের সাথে মিলিয়ে, নিজেরা বাঁচি।”

রাফির জামিন হওয়ার পর পরিস্থিতি যতটা সহজ মনে হয়েছিল, বাস্তবে ততটাই জটিল হয়ে উঠলো।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে আমাদের গল্প।
প্রায় প্রতিটি নিউজ পোর্টাল শিরোনাম করেছে—
"ধর্ষিতা তার ধর্ষককে করলো ক্ষমা— বিয়ে করার ঘোষণা!"
আর সেই শিরোনামের নিচে হাজারো মন্তব্য—
“প্রপাগান্ডা”, “নাটক”, “মেয়েটা টাকার লোভে বেহায়া হয়েছে”, “ধর্ষণ নিয়ে প্রেম সম্ভব?”

আমি প্রতিটা মন্তব্য দেখছিলাম, কিন্তু ভেতরটা কেঁপে উঠছিলো না।
বরং মনে হচ্ছিল, আমি এক পরীক্ষার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে পাস বা ফেল নয়— বরং আত্মবিশ্বাসটাই চূড়ান্ত উত্তর।

বাড়ির উঠোনে সাংবাদিকদের ভিড় আর বন্ধুবান্ধবদের কৌতূহলী চোখে আমাদের পরিবারের স্বাভাবিক জীবন যেন কোথাও হারিয়ে গেছে।

বাবা মুখ বন্ধ করে রেখেছেন, কিন্তু আমি জানি, ভেতরে একটা ঝড় চলছে ওনার মধ্যে।

এক রাতে খাবার টেবিলে বাবার কথাটা স্পষ্ট শুনলাম—

"রম্য, তুমি যদি এক মুহূর্তের জন্যও মনে করো, এই সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল— তাহলে ফিরে এসো মা। ভুল সিদ্ধান্তের দাম অনেক বড় হয়।"

আমি একটু থেমে বাবার দিকে তাকালাম।

"বাবা, তুমি নিজেও জানো, আমি সিদ্ধান্ত নিইনি হঠাৎ করে।
আমি নিজেকে ধ্বংস হতে না দিয়ে, এক অপরাধীকে পরিবর্তনের সুযোগ দিতে চেয়েছি। এটাই আমার প্রতিবাদ, এটাই আমার প্রতিশোধ।"

বাবা এবার আর কিছু বললেন না।
শুধু চুপচাপ উঠে গেলেন।

এদিকে রাফির জীবনও স্বাভাবিক না।

বাড়ি ফিরেছে ঠিকই, কিন্তু তার নিজের পরিবারও তাকে পুরোপুরি মেনে নেয়নি।
তার মা-ও তাকে একরকম দূরে সরিয়ে রেখেছেন।
একমাত্র ছোট বোনটাই পাশে দাঁড়িয়েছে।

রাফি এখন এক সরকারি পুনর্বাসন প্রোগ্রামে অংশ নিচ্ছে।
প্রতিদিন সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নেয়, রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা, শিশুদের পড়ানো—
আর প্রতি সপ্তাহে কাউন্সেলিং সেশনে যেতে হয়।

সে প্রতিদিন একটা ডায়েরি লেখে—
আমার অপরাধ, আমার অনুশোচনা, আমার নতুন জীবন।

একদিন বিকেলে আমি তাকে দেখতে গিয়েছিলাম।

সে আমাকে একটা চায়ের দোকানে নিয়ে গেলো।
আমরা দু’জন সাধারণ মানুষের মতো বসলাম, প্রথমবারের মতো।

সে বললো—
"তুমি কি জানো রম্য, আমি আজকাল ঘুমাতে পারি। কারণ তুমি আমাকে দুঃস্বপ্নে থেকেও আলোর একটা পথ দেখিয়েছো।"

আমি বললাম—
"আমি চাই তুমি বদলে যাও রাফি। আমি চাই, তুমি নিজেকে এমন এক মানুষ বানাও, যাতে অন্য এক রাফির মতো কেউ আর কোনোদিন সেই ভুলটা না করে।"

রাফি কিছু না বলে মাথা নিচু করলো।

কিন্তু... গল্প এখানেই শেষ হয় না।

সেই রাতে একটা ফোন এলো।
অজানা নাম্বার।
আমি ধরলাম।

ওপাশ থেকে একটা ভয়ানক ঠান্ডা কণ্ঠ বললো—

"ভুল করেছো রম্য। রাফি শুধু একজন ছিলো। কিন্তু আমরা তো ছিলাম সাতজন। আর তোমার সেই ‘ক্ষমা’ আমাদের জন্য নয়… আমরা ভুলিনি।"

মাথার ভেতর বাজ পড়ে গেলো।
হাত ঠান্ডা হয়ে এলো।

আমি ফোন রেখে দিলাম।
কিছু বলিনি কাউকে।
শুধু জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

আকাশে আবার সেই লাল নীলিমা।
কিন্তু এবার বাতাসে অজানা শীতলতা।

পরদিন সকালেই থানায় গেলাম।
এসআই ফারহানা বেগম আমাকে চিনতেন।
আমি বললাম—
"আমার সন্দেহ, ওরা ফিরে এসেছে। বাকি ছয়জন।"

তিনি চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করলেন—
"আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে?"

আমি বললাম—
"না। কিন্তু আমি ওদের ভয় পাই না।
আমি শুধু চাই, এদের খুঁজে বের করা হোক। আমি আইনি পথে লড়বো।"

চলবে…


0 Post a Comment:

Post a Comment