রম্য কাহিনী
পর্ব: ৮
লেখক: গিয়াস উদ্দিন আহাম্মাদ
অন্ধকার সেই দিনগুলো একদম কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার মনে ভাঙন ধরেছে, আর সে ফাটল বাড়ছে প্রতিনিয়ত। পরিবারের কেউ কেউ আমার সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে চায় না, কেউ আবার আমাকে ডরাতে চেষ্টা করে। বাবার চোখে ক্লান্তির ছাপ, মায়ের কাঁদার আড়ালে বেদনার ঢেউ, আর ভাইয়ের চুপচাপ চাহনি সব আমাকে ব্যাথিত করে।
রাফির সঙ্গে আমার সম্পর্কও এখন আগের মতো আর নেই। ওর গর্ব আর আমার গৌরব—দুটোরই মধ্যেই ফাটল। ও বলছে, “তুমি বুঝছো না, তোমার এই সিদ্ধান্ত শুধু তোমার নয়, পুরো পরিবারের জীবন বদলে দিচ্ছে।”
আমি বললাম, “তোমারাও কি বুঝবে? আমি এই বিয়ে শুধু আমার জন্য নই, এটা আমার পুঁজি, আমার অস্তিত্ব।”
আমার ভেতরে একটা লড়াই চলছে, একদিকে আমার মন যা চাইছে, অন্যদিকে বাস্তবের কঠিন দেওয়াল। আমি বুঝতে পারি, এই ফাটল যদি না মেরামত করি, তাহলে সবকিছু ভেঙে পড়বে।
একদিন সন্ধ্যায়, আমি একা বসে ছিলাম আমার পুরনো ঘরটার বারান্দায়। বাতাসে একটা মৃদু শীতলতা, আর আকাশে গোধূলির রং মিশে গেছে। সেই সময়ই আমার মোবাইল বেজে উঠল। কলটা রাফির। ভেতর থেকে একটা কাঁটা বেয়ে গেল। আমি রিসিভ করলাম।
“আমরা কথা বলি, ঠিকঠাক,” ও বলল। “তোমার সঙ্গে একটা দরকারি কথা আছে।”
“ঠিক আছে,” আমি বললাম, “আসো দেখা করি।”
আমি জানতাম, ওর কথাগুলো সহজ হবে না, কিন্তু জানতেও চাইছিলাম। কারণ, হয়তো এই ফাটল মেরামত হওয়ার একমাত্র সুযোগ।
রাফির কণ্ঠ ছিল কঠিন, কিন্তু ভেতর থেকে যেন একটা ঝিঁঝিঁর সুর ছুঁটে আসছিল। আমরা দুইজনই সেই ছোট্ট কফি শপে বসেছিলাম, যেখানে কতদিন আগেও আমরা একসঙ্গে স্বপ্ন গড়তাম। আজ সেই স্বপ্ন গুঁড়িয়ে গেছে, তার ভিতরে শুধু প্রশ্ন আর সন্দেহ।
“তুমি জানো, আমি তোমাকে কেন এত ত্যাগ করতে বলছি?” রাফি চোখের দিকে তাকিয়ে বলল।
আমি গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, “না, জানি না।”
“কারণ, তুমি নিজের জন্যই লড়ছো, শুধু নিজের জন্য। কিন্তু তুমি কি বুঝছো, এই লড়াই তোমার চারপাশের মানুষদের জীবনেও কতটা প্রভাব ফেলে?”
আমি চুপ করে রাফির কথা শুনতে লাগলাম। ওর কথায় এমন এক ব্যথা মিশে ছিল, যা আমি এতদিন বুঝিনি।
“আমি চাইনি তোমাকে হারাতে,” ও বলল। “কিন্তু আমরা যদি একসঙ্গে না দাঁড়াই, তাহলে কেউই বাঁচতে পারবে না।”
আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি কাঁদছিলাম, আর সেই কাঁদায় ছিল ঘৃণা, ভালোবাসা, ব্যথা সবকিছু মিশ্রিত। “আমি তোমাকে শুধু আমার স্বপ্নের জন্য নয়, আমার বাঁচার জন্যও চাই,” আমি বললাম।
আমরা দুইজনই বুঝেছিলাম, এই মুহূর্তটা আমাদের সম্পর্কের নতুন সূচনা হতে পারে। ব্যথার মাঝেও এক ধরনের আশা জাগছে।
বাইরের আকাশে তখন মেঘ ঘনিয়ে আসছিল, ঠিক যেন আমাদের জীবনের অন্ধকারের পর প্রভাতের অপেক্ষা।
রাফির কথা মনে মনে ঘুরে ফিরে বাজছিল, যেন কোনো অজানা সুর। কফি শপ থেকে বের হয়ে আমি শহরের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম। মনটা ছিল অস্থির, চোখে মেঘের মতো ঘোর কাঁপছিল।
যতই চেষ্টা করি নিজেকে বুঝাতে, কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলাম, কেন আমি তাদের একজনের সাথে বিয়ে করতে চাই, হৃদয় কাঁপতেই থাকল।
আমার মনের গভীরে লুকানো একটা অন্ধকার আলো জ্বলে উঠেছিল—ব্যথা আর আশা একসঙ্গে গড়ে তোলে এক নতুন জ্যোতি।
আমি জানতাম, এই বিয়ে আমার জন্য শুধু ব্যক্তিগত লড়াই নয়, আমার পরিবারের জন্যও এক দৃষ্টান্ত। এটা ছিল আমার সম্মানের লড়াই, রক্তাক্ত হলেও।
এক হাতে আমার বাবার হাত ছুঁই, আর অন্য হাতে সেই ছেলের নাম বারবার মনে পড়ছিল, যার সাথে আমি বিয়ে করতে চাই। সে যেই হোক, আমার জীবনের অন্ধকারে একদম আলোর রেখা।
আমার আত্মবিশ্বাস আরও শক্ত হলো, আমার পথ অন্ধকার হলেও, আমি হার মানব না।
আগামী দিনগুলো আরও কঠিন হবে, কিন্তু আমি প্রস্তুত।
চলবে...
0 Post a Comment:
Post a Comment