রম্য কাহিনী পর্ব: ৭ লেখক: গিয়াস উদ্দিন আহাম্মাদ

 




রম্য কাহিনী

পর্ব: ৭
লেখক: গিয়াস উদ্দিন আহাম্মাদ

সকাল ৯টা ৩৪ মিনিট।
এক কাপ গরম কফির ধোঁয়া হালকা করে জানালার দিকে উড়ে যাচ্ছিলো।
কিন্তু আমার ভিতরের আতঙ্ক ঠিক সেই ধোঁয়ার মতো করে ছড়িয়ে পড়ছিলো…
সেই অজানা নম্বরের ফোন কল—
আর তার মধ্যে লুকানো হুমকি যেন আমার বুকের মধ্যে এক বিষাক্ত কাঁটা গেঁথে রেখেছে।

আমি রাফিকে জানাইনি কিছু।
জানালেই সে ভেঙে পড়বে, আবার নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করবে।
আমি জানি, ও এখনো নিজের জন্য ক্ষমা করে উঠতে পারেনি।

দুপুরের দিকে পুলিশ এসে আমাদের বাসায় গেল।
তদন্ত শুরু হয়েছে, তবে নতুন কোনো ক্লু মেলেনি।
কিন্তু এরপর থেকে প্রতিদিনই একটা না একটা আজব ঘটনা ঘটতে লাগলো।

  • কারেন্ট চলে যায় শুধু আমাদের বাড়িতে।

  • অচেনা লোকজন দেয়ালের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়।

  • প্রতিদিন দরজায় প্যাকেট পড়ে থাকে— কখনো মেয়েলি জামা, কখনো পুড়ানো ছবি, কখনো রক্তমাখা পুতুল!

মা আর দিদি তো আতঙ্কে নাওয়া খাওয়া ভুলে গেছে।
বাবা নিজে থানায় গিয়েছিলেন— কিন্তু পুলিশ বলছে কোনো প্রমাণ নেই, তাই কিছু করা যাচ্ছে না।
বাবা ফেরার সময় শুধু বলেছিলেন—
“এই সমাজে নারী শক্তি বলে কিছু নেই রম্য। তুমি একা এক সংগ্রামে নেমেছো— শুধু সাহস নয়, এখন বুদ্ধিরও পরীক্ষা।”

রাত ১১টা।

হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো।
জানালার কাঁচ ভাঙার মতো শব্দ!

চোখ মেলে দেখলাম জানালার কাঁচ ভেঙে ঘরের ভেতর একটা কাগজ পড়ে আছে।

দৌড়ে গিয়ে সেটা হাতে নিলাম—
লাল রঙে লেখা:

"তোমার শুদ্ধতার নাটক বন্ধ করো। না হলে ইতিহাস আবারও ফিরে আসবে— এবার আর কেউ তোমার পাশে দাঁড়াবে না।"

পরদিন সকালে থানায় গিয়ে এসআই ফারহানাকে চিঠিটা দেখালাম।
উনি সেটা হাতে নিয়ে গম্ভীর হয়ে পড়লেন।

“এটা নিছক ভয় দেখানোর চেষ্টা না, এই চিঠিতে একটা গন্ধ আছে রম্য।”

আমি অবাক হয়ে বললাম—
“কোন গন্ধ?”

উনি বললেন—
“চিঠির কাগজটা দামী, এই রকম কাগজ সাধারণত অভিজাত ঘরের কেউ ব্যবহার করে। আর কালি? এই কালি সরকার অনুমোদিত কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোথাও পাওয়া যায় না।”

আমি বললাম—
“মানে, ওরা এখনো সমাজের অভিজাত গোষ্ঠীর ভিতরে লুকিয়ে আছে?”

উনি বললেন—
“সম্ভব। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— কেউ তোমার চারপাশে আছে, যিনি তোমার সবকিছু জানে।”

আমি চমকে উঠলাম।

বাড়ি ফিরে আসতেই মা বললো—
“আজ সকালে রাফি এসেছিল। তোমার খোঁজ নিয়েছে, কিন্তু তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা— সেটা বারবার জানতে চাইছিলো।”

আমি চুপ করে গেলাম।
রাফি এখনো জানে না আমি হুমকি পাচ্ছি।
আমি তাকে এই যুদ্ধের অংশ করতে চাই না, কিন্তু সেই ছায়া আমাকে যেন ছাড়ছে না।

সন্ধ্যায় রাফির বাসায় গেলাম।

ও আমাকে দেখে হকচকিয়ে গেলো।

“তুমি! এই সময়?”

আমি বললাম—
“আমাকে কিছু কথা বলতেই হবে রাফি। এই যুদ্ধে তুমি চাইলেও আলাদা থাকতে পারবে না। কারণ ‘ওরা’ ফিরে এসেছে।”

ও হতভম্ব হয়ে গেলো।

আমি সবটা বললাম— অজানা নম্বর, হুমকির চিঠি, কাঁচ ভাঙা, রাতের ছায়া, সব কিছু।

রাফি মাথা নিচু করে বসে রইলো কিছুক্ষণ।

তারপর বললো—

“আমি জানি, আমার আগে যা করেছি— তার কোনো ক্ষমা নেই। কিন্তু এখন যদি তুমি আমাকে পাশে থাকতে দাও, আমি অন্তত একজন পাহারাদার হতে পারি। আমি এখনো যুদ্ধ করতে শিখিনি রম্য, কিন্তু তোমার জন্য লড়তে চাই। এইবার আমাকে তোমার পাশে দাঁড়াতে দাও।"

আমি চুপ করে রইলাম।
কিন্তু মনে মনে ঠিক করলাম—
এইবার আমি আর পালিয়ে যাবো না।

এইবার শুধু "ক্ষমা" দিয়ে শেষ করবো না।
এইবার বিচার করবো। শাস্তি নিশ্চিত করবো।
কারণ আমি শুধু একজন ধর্ষণের শিকার নারী নই,
আমি একজন যোদ্ধা। আমি রম্য।




আমার মনের ভেতর এক অসহ্য অন্ধকার বাসা বাঁধছে। প্রত্যেক মুহূর্তে মনে হচ্ছে যেনো গা ঘেঁষে বসে আছে ভয় আর সন্দেহ। বাবার কথা, পরিবারের প্রশ্ন আর সেই সাতজনের চেহারা বার বার চোখে ভেসে ওঠে। আমি জানি, এ পথে হেঁটে ফিরে আসা সহজ হবে না।

রাফি আমার জীবনে হঠাৎ ঝড়ের মত ঢুকে পড়েছে। ওর রাগ আর গোপনীয়তা আমাকে বার বার বিভ্রান্ত করে। ওর চোখের সেই তীব্রতা যেনো আমার প্রতি এক ধরনের দ্বৈত প্রেম এবং ঘৃনার মিশ্রণ। ও যখন কাছে আসে, তখন আমার হারানো নিরাপত্তার খোঁজ পাই। কিন্তু যখন ও দূরে সরে যায়, তখন আমার ভয় আবার ফিরে আসে।

আমার বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক এখন যেনো ক্রন্দনের ধারায় ভেসে যাচ্ছে। উনি আমার জন্য সব করতে চায়, কিন্তু আমার সিদ্ধান্তগুলোকে স্বীকার করে নিতে পারছেন না। আমি জানি, উনি চান আমার জীবনে শান্তি হোক। কিন্তু শান্তি পেতে গেলে আমাকে প্রথমে আমার অন্ধকারের মুখোমুখি হতে হবে।

একদিন বিকালে, আমি রাফির সঙ্গে শহরের এক ছোট কফি শপে বসেছিলাম। ও ধীরে ধীরে বললো, “তুমি জানো, আমি কেনো এ জগতে এত রাগে আবদ্ধ?” আমি চুপ করে ছিলাম। ও বললো, “আমার জীবনও তোমার মতোই অন্ধকারে ভরা। আমি চাই তোমাকে বাঁচাতে, কিন্তু জানি না নিজের থেকে বাঁচাতে পারব কিনা।”

আমি ওর হাতে হাত রাখলাম। প্রথমবারের মতো অনুভব করলাম, আমরা দুজনই এক রকম নিঃসঙ্গ, কিন্তু একই রকম শক্তিশালী। এই শক্তি যদি একসাথে হয়ে দাঁড়াতে পারে, তাহলে হয়তো আমরা অন্ধকারকে হারাতে পারবো।

কিন্তু এই আশা কি সত্যিই মিশন সম্ভব? আমার মাথায় হাজার প্রশ্ন ঘুরছে। ওদের সাতজন, আমার পরিবার, আমার নিজের মন – সবকিছু যেনো যুদ্ধক্ষেত্র।

চলবে...



0 Post a Comment:

Post a Comment